মাংস

 খান মুহাম্মদ রুমেল ||

ঈদের দিন। প্রায় শেষ বিকেল। হাতে ঘড়ি নেই। তবে আন্দাজে মনে হয় সাড়ে তিনটা কি চারটা বাজে।

শহরের ব্যস্ত মোড়ে ভিড় নেই। যানবাহনের অযথা জট নেই। গাড়ির হর্নে, মানুষের অযাচিত চিৎকারে কান ঝালাপালা নেই। বের হয়েছি সিগারেটের খোঁজে। বাসার সামনের গলির সবগুলো দোকান বন্ধ। গলির মুখের ফুটপাতে বসে কমপক্ষে সাড়ে পাঁচজন পান সিগারেটওয়ালা। সাড়ে পাঁচ বলছি কারণ, চারজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে একটি দশ-বারো বছরের পিচ্চিও বসে। কিন্তু তারা আজ কেউ নেই। সবার আজ ছুটি। ঈদের ছুটি। শহরজুড়ে। দেশজুড়ে। সবাই উদযাপনে ব্যস্ত। আনন্দে মাতোয়ারা। এমনকি গলিতে একটা প্লাস্টিকের বস্তা বিছিয়ে দিনমান বসে থাকা লোকমান মিয়াও আজকে ভিক্ষা করতে বের হননি। অথবা হয়েছেন। কিন্তু এখানে তার উপস্থিতি নেই।

 

ঘুমিয়েছি শেষ রাতের দিকে। এমন মরার ঘুম দিয়েছি, কখন সকাল হয়েছে, সেই ঈদের সকাল গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে এগিয়ে গেছে কিছুই টের পাইনি! এমন বেঘোর ঘুম কেউ ঘুমায়? মাথাটা টলছে এখন। নিকোটিনের জন্য শরীর নিশপিশ করছে। গলিতে কাউকে না পেয়ে হাঁটতে থাকি বড় রাস্তার দিকে। নাকে এসে লাকে কোরবানির পশু জবাইয়ের রক্তের ঝাঁঝালো গন্ধ। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গরুর নাড়িভুঁড়ি। সিটি করপোরেশনের লোকদের দেখা যাচ্ছে। অলস পায়ে ময়লা সরানোর কাজ শুরু করেছেন তারা। কোনো তাড়া নেই। কোনো বিকার নেই।

বড় রাস্তার মোড়ে আসতেই চোখে পড়ে খোলা আছে দুয়েকটি স্টেশনাররি দোকান। এমনকি খোলা আছে ফুটপাতজুড়ে বিছিয়ে থাকা কয়েকটি চায়ের দোকান। একটু পরই সিগারেটে টান দিতে পারবো মনে হতেই শরীর মন খুব চনমনে হয়ে ওঠে। লম্বা লম্বা পা ফেলে বড় সড়কটা পার হওয়ার সময় চোখে পড়ে রাস্তার পাশের এক চায়ের দোকানের পাশ ঘেঁষে তিন-চারটা ছোট ছোট জটলা। ‘রতন জেনারেল স্টোর’ থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে, লাইটারের খোঁজ করতে করতে এবার সেই জটলাগুলোর দিকে ভালো করে তাকাই। নজরে পড়ে মাংসের দোকান। আগ্রহ বাড়ে। কৌতূহল নিয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখতে থাকি মাংসের বাজারের কাজ কারবার। কোরবানির মাংস বিক্রি হচ্ছে এখানে। কেজি হিসাবে নয়। ভাগ হিসাবে। তিন ধরনের ভাগ। তিনশ, পাঁচশো এবং এক হাজার টাকা করে প্রতি ভাগ মাংসের দাম। রিকশা চালক, সিএনজি অটোরিকশার চালকসহ নিম্নবিত্তের মানুষ জটলা করে হাঁকডাক দরদামে কিনছেন মাংস। কিছু মানুষকে আবার দেখা যাচ্ছে এদিক সেদিক তাকিয়ে দ্রুত জটলার মধ্যে ঢুকে মাংসের পোটলা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। এঁদের চোখে মুখে কেমন যেন একটা ভীতিকর, অস্বস্তিকর ছাপ। তাদের সংকোচিত ভাব- কেউ দেখে ফেলছে কিনা। যেন কোনো নিষিদ্ধপল্লীতে গোপনে ঢুকে পড়েছেন। কেউ দেখে ফেললেই বিপদ। স্বভাব দোষেই হোক আর অভ্যাস বশেই হোক- একটু দূরে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি।

বিন্দুকে কেন্দ্র করে যেমন চারপাশ জুড়ে রচিত হয় বৃত্ত, কয়েকজনকে দেখছি- মাংসের বাজারের জটলাকে কেন্দ্র করে সেরকম ঘুরছেন। কিন্তু মিশে যেতে পারছেন না জটলায়। এদের মধ্যে শাদা চেক লুঙ্গি এবং হালকা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি পরা একজনের দিকে চোখ আটকে যায় আমার। পরিচ্ছন্ন পাঞ্জাবিতে  ইস্ত্রির ভাঁজ। তবে বোঝা যায় পাঞ্জাবিটা কয়েক বছরের পুরনো। তবে পরনের লুঙ্গিটা নতুন। বয়স পঞ্চাশের এদিক ওদিক একটু কম বেশি হতে পারে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। রিকশা থেকে নেমে জটলা ঘিরে কয়েক চক্কর দিলেন। কিন্তু কিছুতেই মাংসের কারবারির কাছে যেতে পারছেন না। এক পর্যায়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালেন। কিন্তু তার চোখ স্থির হয়ে আছে জটলার দিকে। দেখলেই বোঝা যায় ভিড় কমার অপেক্ষায় আছেন। হয়তো এই ভিড়ে মাংস কিনতে অস্বস্তিবোধ হচ্ছে তার। কোনো কিছু না ভেবেই এগিয়ে গেলাম তার দিকে।

 

– আপনি কি মাংস কিনতে আসছেন?
অল্পক্ষণ কি যেন ভাবলেন তিনি। তারপর হয়তো আমাকেও তার নিজের দলের লোক মনে করেছেন। কারণ তার মতো আমিও অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি এখানে। একটার পর একটা সিগারেট টেনে চলেছি এবং তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছি মাংস বেচাকেনার দিকে। সুতরাং আমাকে কিছুটা আস্থায় নেন তিনি। সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন- হুম্!
– কিনে ফেলেন। বেশি দেরি করলে শেষ হয়ে যাবে!
– এই ভিড় ঠেইলা কেমনে কিনি! আপনেও তো কিনতে পারতাসেন না!
এই কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করি, কতো টাকা বাজেট আপনার?
– পাঁচ ছয়শো টাকার কিনলেই হইবো!
– আমার পছন্দ মতো কিনে দিলে হবে?

তিনি রাজি হতেই ভিড় ঠেলে ঢুকে যাই জটলার মধ্যে। ছয়শো টাকায় দুই ভাগ মাংস কিনি। আড়াই তিন কেজি ওজন হতে পারে। বের হয়ে এসে তার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিতেই মায়াভরা চোখে তিনি জিজ্ঞেস করেন, আপনারটা কিনলেন না?
– আমি মাংস কিনতে আসিনি। খুব নরম সুরে বলি তাকে।

এবার আমার দিকে খুব ভালো করে নজর দেন তিনি। আমার গায়ে রং চটে যাওয়া পুরনো একটা টিশার্ট। পরনে রাতে শোয়ার সময় পরা একটা মলিন সুতির ট্রাউজার। পায়ে বৃষ্টির দিনে পরার উপযোগী রাবারের স্যান্ডেল। তাতে আবার লেগে আছে দুদিন আগের বৃষ্টির কাদা। মুখে তিন চারদিনের না কামানো খোচা খোচা দাড়ি। সব মিলিয়ে ফড়িয়া টাইপ একটা লেবাস। কি যেন ভাবতে থাকেন তিনি। হয়তো মনে মনে পরখ করছেন আমাকে। বোঝার চেষ্টা করছেন আমি কে।
কড়কড়ে সেই বিকেল ছোঁয়া দুপুরে তিনি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেন একটা বিশ টাকার নোট। আমাকে মাংসের বাজারের দালাল ভেবেছেন তিনি! একবার ভাবি বিশ টাকার নোটটা নিয়ে কেটে পড়ি। কিন্তু ওই যে শুরুতে বললাম, কিছু স্বভাব দোষ আছে আমার! তাই টাকাটা না নিয়ে বরং তাকে বলি, বকশিশের দরকার নেই। তবে আমার কিছু প্রশ্ন আছে আপনার কাছে। উত্তর দেবেন?

 

– জি বলেন!
– বাজারে তো মাংস পাওয়া যায়। তবুও এখান থেকে কেন কিনলেন?
– কিনসি কি আর শখ কইরা! গত চাইর পাঁচ মাস ধইরা অফিস অর্ধেক বেতন দেয়। বাজারে তো আগুন লাগসে। কোনো কিছুতে হাত দেয়ন যায় না। প্রতি বছর ঈদে গ্রামের বাড়ি গিয়া কোরবানি দিতাম। এবার তাও পারি নাই।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেন তিনি। দম নেয়ার জন্য একটু থামলে পাল্টা প্রশ্ন করি, সরি, কোরবানির মাংস পান নাই কারো কাছ থেকে?
– না, আমরা ভাড়াটিয়া। ভাড়াটিয়ারে কে মাংস দিবো? এদিকে সকালের পর থেকে বাচ্চাগুলা খুব
জ্বালাইতেসে কোরবানির মাংস খাইবো! তাই না পাইরা এখানে কিনতে আইলাম।

এরপর দুজনেই নীরব হয়ে যাই। চুপচাপ পাশাপাশি বসে থাকি দুজন। আমরা কিছুই বলি না। চা দোকানি আমাদের দুজনের হাতে দু’কাপ চা ধরিয়ে দেয়। আমি প্যাকেট থেকে দুইটা সিগারেট বের করে একটা তাকে দিই একটা নিজে ধরাই। এক সময় নীরবতা ভাঙেন তিনি।
– তা, আপনি এখানে কী করেন?
– কিছু করি না। ঘটনা দেখি। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি।
– ওহ! কি জানি ভাই! বুঝি না এতো কিছু। আরেকটু চা খান।
– তা খাওয়া যেতে পারে!

 

দ্বিতীয় দফা চা খাওয়ার সময় আর কোনো কথা হলো না। চায়ের বিলটা তিনিই দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দোকানিকে আগেই ইশারা দিয়ে রাখায় বিল নিতে রাজি হয়নি। হয়তো আবারও বিব্রত হলেন তিনি। কোনো কথা না বলে, কোনো বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে একটি খালি রিকশায় উঠে বসলেন তিনি। ঈদের দিনের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে রিকশা। আর রাস্তা ফাঁকা এবং মানুষশূন্য বলেই অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো রিকশাটা। আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি। কেন জানি তাকিয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে আমার। তার সন্তানদের চিনি না। কোনোদিন দেখিনি। দেখার প্রশ্নও উঠে না। তবুও চোখের সামনে ভাসতে থাকে একের পর এক দৃশ্য। মধ্যবয়স্ক এই লোকটি রিকশা থেকে নেমেছেন শহরের কোনো এক প্রান্তে। সেটি বাংলামোটর, গোড়ান, বাড্ডা, মিরপুর, হাজারিবাগ, লালবাগ, শান্তিনগর যে কোনো জায়গা হতে পারে। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে হেঁটে চলেছেন তিনি। হয়তো অল্প একটু দূর হাঁটা পথ শেষে তার বাসা। হয়তো সেটি খুব সরু গলি। হয়তো সেখানে রিকশা ঢোকে না। কিংবা হয়তো একেবারে ঘরের দরজার সামনেই নেমেছেন। তারপর একবার, মাত্র একবার মৃদু হাতে কড়া নাড়তেই খুলে গেছে বাসার দরজা। কারণ এই ভাড়া বাড়ির তিনটি সন্তান জানে তাদের জন্য কোরবানির মাংস আনতে গেছেন তাদের বাবা। তাই তারা অপেক্ষা করছে কখন ফিরবেন। হয়তো মৃদু হাতে কড়া নাড়ার শব্দেই সন্তানরা বুঝে গেছে এটি তাদের বাবার কড়া নাড়ার শব্দ।

হয়তো তার হাতের মাংসের পোটলাটি দেখে দৌড়ে এগিয়ে এসেছে তাদের সবচেয়ে ছোট সন্তান। হয়তো বাবার হাত থেকে ছোঁ মেরে ব্যাগটি কেঁড়ে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে ভোঁ দৌড় দিয়েছে সেই শিশুটি। হয়তো তখন রান্নাঘরে বসে তাদের মা মাংস রান্নার জন্য পেঁয়াজ কুটছিলেন। হয়তো মা পেঁয়াজ কুটছিলেন না। বরং জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন বাইরের দিকে। সেখানে আশপাশের বড় বড় বিল্ডিংয়ের ফাঁক গলে হয়তো এক চিলতে আকাশ দেখা যাচ্ছিল অথবা যাচ্ছিল না। হয়তো মাংসের পোটলা হাতে পেয়ে মা, মাংস কোটাবাছার পর রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হয়তো ছোট্ট শিশুটি বলছিল- মা আজকে চাল একটু বেশি করে দিবা। আজকে কিন্তু আমি অনেক ভাত খাবো! মা হয়তো তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছিলেন- আচ্ছা খেয়ো। যতো খুশি খেয়ো। ওদিকে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বাবা হয়তো ততোক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন সেই বিকেলে। কিংবা তিনি হয়তো বসে বসে টিভি দেখছিলেন। হয়তো ঘরময় গরম মশলার মৌ মৌ গন্ধে বিভোর তখন। গরম পোলাও থেকে ধোঁয়া উঠছে। সবাই মিলে খেতে বসেছে টেবিলে। হয়তো সেই বাড়িতে কোনো খাবার টেবিল নেই। হয়তো সবার চোখে মুখে লেগেছে কোরবানির ঈদের আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। এতো সব আনন্দের মাঝে শুধু বাবার মনটা খচখচ করছে খুব। তার সব অশ্রু বাষ্প হয়ে মিশে যাচ্ছে গরুর মাংসের সালুনের খুশবু আর পোলাওয়ের ধোঁয়ায়। নিজের অভাবকে কোরবানি দিতে না পারা গাঢ় অক্ষমতায় বাবার গলা দিয়ে হয়তো খাবার নামতে চাইছে না। তবু তিনি খুব আনন্দ নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছেন।

 

হঠাৎ সিটি করপোরেশনের একটি ময়লাবাহী ঘড়ঘড় শব্দ তুলে এগিয়ে আসে রাস্তা ধরে। আর ময়লার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ ঝাপটা মারে নাকে। চোখের সামনে থেকে সরে যায় একটি সুখি পরিবারের মায়াবি পর্দা। খেয়াল করে দেখি নিভে গেছে হাতের সিগারেট। আরো এক প্যাকেট সিগারেট কিনে হাঁটতে থাকি বাসার দিকে।
খুব ক্লান্ত লাগে।

সূএ: রাইজিংবিডি.কম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ওমরা করার উত্তম সময় কোনটি

» মোবাইল ফোন চার্জ দিতে কত টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়?

» টি-টেন লিগে ফের ফিক্সিংয়ের গুঞ্জন!

» উপ-রাষ্ট্রপতি ও উপ-প্রধানমন্ত্রীসহ বিএনপির ৬২ প্রস্তাবনা

» শেখ হাসিনাসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে হেফাজতের অভিযোগ

» সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে দুই পক্ষের সংঘর্ষে যুবদল কর্মী খুন

» চিন্ময় কৃষ্ণকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে হস্তান্তর

» ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশার ৫ যাত্রী নিহত

» চশমার যত্ন

» বর্তমানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ নেই

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

মাংস

 খান মুহাম্মদ রুমেল ||

ঈদের দিন। প্রায় শেষ বিকেল। হাতে ঘড়ি নেই। তবে আন্দাজে মনে হয় সাড়ে তিনটা কি চারটা বাজে।

শহরের ব্যস্ত মোড়ে ভিড় নেই। যানবাহনের অযথা জট নেই। গাড়ির হর্নে, মানুষের অযাচিত চিৎকারে কান ঝালাপালা নেই। বের হয়েছি সিগারেটের খোঁজে। বাসার সামনের গলির সবগুলো দোকান বন্ধ। গলির মুখের ফুটপাতে বসে কমপক্ষে সাড়ে পাঁচজন পান সিগারেটওয়ালা। সাড়ে পাঁচ বলছি কারণ, চারজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে একটি দশ-বারো বছরের পিচ্চিও বসে। কিন্তু তারা আজ কেউ নেই। সবার আজ ছুটি। ঈদের ছুটি। শহরজুড়ে। দেশজুড়ে। সবাই উদযাপনে ব্যস্ত। আনন্দে মাতোয়ারা। এমনকি গলিতে একটা প্লাস্টিকের বস্তা বিছিয়ে দিনমান বসে থাকা লোকমান মিয়াও আজকে ভিক্ষা করতে বের হননি। অথবা হয়েছেন। কিন্তু এখানে তার উপস্থিতি নেই।

 

ঘুমিয়েছি শেষ রাতের দিকে। এমন মরার ঘুম দিয়েছি, কখন সকাল হয়েছে, সেই ঈদের সকাল গুটিগুটি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে এগিয়ে গেছে কিছুই টের পাইনি! এমন বেঘোর ঘুম কেউ ঘুমায়? মাথাটা টলছে এখন। নিকোটিনের জন্য শরীর নিশপিশ করছে। গলিতে কাউকে না পেয়ে হাঁটতে থাকি বড় রাস্তার দিকে। নাকে এসে লাকে কোরবানির পশু জবাইয়ের রক্তের ঝাঁঝালো গন্ধ। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গরুর নাড়িভুঁড়ি। সিটি করপোরেশনের লোকদের দেখা যাচ্ছে। অলস পায়ে ময়লা সরানোর কাজ শুরু করেছেন তারা। কোনো তাড়া নেই। কোনো বিকার নেই।

বড় রাস্তার মোড়ে আসতেই চোখে পড়ে খোলা আছে দুয়েকটি স্টেশনাররি দোকান। এমনকি খোলা আছে ফুটপাতজুড়ে বিছিয়ে থাকা কয়েকটি চায়ের দোকান। একটু পরই সিগারেটে টান দিতে পারবো মনে হতেই শরীর মন খুব চনমনে হয়ে ওঠে। লম্বা লম্বা পা ফেলে বড় সড়কটা পার হওয়ার সময় চোখে পড়ে রাস্তার পাশের এক চায়ের দোকানের পাশ ঘেঁষে তিন-চারটা ছোট ছোট জটলা। ‘রতন জেনারেল স্টোর’ থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে, লাইটারের খোঁজ করতে করতে এবার সেই জটলাগুলোর দিকে ভালো করে তাকাই। নজরে পড়ে মাংসের দোকান। আগ্রহ বাড়ে। কৌতূহল নিয়ে আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখতে থাকি মাংসের বাজারের কাজ কারবার। কোরবানির মাংস বিক্রি হচ্ছে এখানে। কেজি হিসাবে নয়। ভাগ হিসাবে। তিন ধরনের ভাগ। তিনশ, পাঁচশো এবং এক হাজার টাকা করে প্রতি ভাগ মাংসের দাম। রিকশা চালক, সিএনজি অটোরিকশার চালকসহ নিম্নবিত্তের মানুষ জটলা করে হাঁকডাক দরদামে কিনছেন মাংস। কিছু মানুষকে আবার দেখা যাচ্ছে এদিক সেদিক তাকিয়ে দ্রুত জটলার মধ্যে ঢুকে মাংসের পোটলা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। এঁদের চোখে মুখে কেমন যেন একটা ভীতিকর, অস্বস্তিকর ছাপ। তাদের সংকোচিত ভাব- কেউ দেখে ফেলছে কিনা। যেন কোনো নিষিদ্ধপল্লীতে গোপনে ঢুকে পড়েছেন। কেউ দেখে ফেললেই বিপদ। স্বভাব দোষেই হোক আর অভ্যাস বশেই হোক- একটু দূরে দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি।

বিন্দুকে কেন্দ্র করে যেমন চারপাশ জুড়ে রচিত হয় বৃত্ত, কয়েকজনকে দেখছি- মাংসের বাজারের জটলাকে কেন্দ্র করে সেরকম ঘুরছেন। কিন্তু মিশে যেতে পারছেন না জটলায়। এদের মধ্যে শাদা চেক লুঙ্গি এবং হালকা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি পরা একজনের দিকে চোখ আটকে যায় আমার। পরিচ্ছন্ন পাঞ্জাবিতে  ইস্ত্রির ভাঁজ। তবে বোঝা যায় পাঞ্জাবিটা কয়েক বছরের পুরনো। তবে পরনের লুঙ্গিটা নতুন। বয়স পঞ্চাশের এদিক ওদিক একটু কম বেশি হতে পারে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। রিকশা থেকে নেমে জটলা ঘিরে কয়েক চক্কর দিলেন। কিন্তু কিছুতেই মাংসের কারবারির কাছে যেতে পারছেন না। এক পর্যায়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালেন। কিন্তু তার চোখ স্থির হয়ে আছে জটলার দিকে। দেখলেই বোঝা যায় ভিড় কমার অপেক্ষায় আছেন। হয়তো এই ভিড়ে মাংস কিনতে অস্বস্তিবোধ হচ্ছে তার। কোনো কিছু না ভেবেই এগিয়ে গেলাম তার দিকে।

 

– আপনি কি মাংস কিনতে আসছেন?
অল্পক্ষণ কি যেন ভাবলেন তিনি। তারপর হয়তো আমাকেও তার নিজের দলের লোক মনে করেছেন। কারণ তার মতো আমিও অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি এখানে। একটার পর একটা সিগারেট টেনে চলেছি এবং তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছি মাংস বেচাকেনার দিকে। সুতরাং আমাকে কিছুটা আস্থায় নেন তিনি। সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন- হুম্!
– কিনে ফেলেন। বেশি দেরি করলে শেষ হয়ে যাবে!
– এই ভিড় ঠেইলা কেমনে কিনি! আপনেও তো কিনতে পারতাসেন না!
এই কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করি, কতো টাকা বাজেট আপনার?
– পাঁচ ছয়শো টাকার কিনলেই হইবো!
– আমার পছন্দ মতো কিনে দিলে হবে?

তিনি রাজি হতেই ভিড় ঠেলে ঢুকে যাই জটলার মধ্যে। ছয়শো টাকায় দুই ভাগ মাংস কিনি। আড়াই তিন কেজি ওজন হতে পারে। বের হয়ে এসে তার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিতেই মায়াভরা চোখে তিনি জিজ্ঞেস করেন, আপনারটা কিনলেন না?
– আমি মাংস কিনতে আসিনি। খুব নরম সুরে বলি তাকে।

এবার আমার দিকে খুব ভালো করে নজর দেন তিনি। আমার গায়ে রং চটে যাওয়া পুরনো একটা টিশার্ট। পরনে রাতে শোয়ার সময় পরা একটা মলিন সুতির ট্রাউজার। পায়ে বৃষ্টির দিনে পরার উপযোগী রাবারের স্যান্ডেল। তাতে আবার লেগে আছে দুদিন আগের বৃষ্টির কাদা। মুখে তিন চারদিনের না কামানো খোচা খোচা দাড়ি। সব মিলিয়ে ফড়িয়া টাইপ একটা লেবাস। কি যেন ভাবতে থাকেন তিনি। হয়তো মনে মনে পরখ করছেন আমাকে। বোঝার চেষ্টা করছেন আমি কে।
কড়কড়ে সেই বিকেল ছোঁয়া দুপুরে তিনি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেন একটা বিশ টাকার নোট। আমাকে মাংসের বাজারের দালাল ভেবেছেন তিনি! একবার ভাবি বিশ টাকার নোটটা নিয়ে কেটে পড়ি। কিন্তু ওই যে শুরুতে বললাম, কিছু স্বভাব দোষ আছে আমার! তাই টাকাটা না নিয়ে বরং তাকে বলি, বকশিশের দরকার নেই। তবে আমার কিছু প্রশ্ন আছে আপনার কাছে। উত্তর দেবেন?

 

– জি বলেন!
– বাজারে তো মাংস পাওয়া যায়। তবুও এখান থেকে কেন কিনলেন?
– কিনসি কি আর শখ কইরা! গত চাইর পাঁচ মাস ধইরা অফিস অর্ধেক বেতন দেয়। বাজারে তো আগুন লাগসে। কোনো কিছুতে হাত দেয়ন যায় না। প্রতি বছর ঈদে গ্রামের বাড়ি গিয়া কোরবানি দিতাম। এবার তাও পারি নাই।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেন তিনি। দম নেয়ার জন্য একটু থামলে পাল্টা প্রশ্ন করি, সরি, কোরবানির মাংস পান নাই কারো কাছ থেকে?
– না, আমরা ভাড়াটিয়া। ভাড়াটিয়ারে কে মাংস দিবো? এদিকে সকালের পর থেকে বাচ্চাগুলা খুব
জ্বালাইতেসে কোরবানির মাংস খাইবো! তাই না পাইরা এখানে কিনতে আইলাম।

এরপর দুজনেই নীরব হয়ে যাই। চুপচাপ পাশাপাশি বসে থাকি দুজন। আমরা কিছুই বলি না। চা দোকানি আমাদের দুজনের হাতে দু’কাপ চা ধরিয়ে দেয়। আমি প্যাকেট থেকে দুইটা সিগারেট বের করে একটা তাকে দিই একটা নিজে ধরাই। এক সময় নীরবতা ভাঙেন তিনি।
– তা, আপনি এখানে কী করেন?
– কিছু করি না। ঘটনা দেখি। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করি।
– ওহ! কি জানি ভাই! বুঝি না এতো কিছু। আরেকটু চা খান।
– তা খাওয়া যেতে পারে!

 

দ্বিতীয় দফা চা খাওয়ার সময় আর কোনো কথা হলো না। চায়ের বিলটা তিনিই দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দোকানিকে আগেই ইশারা দিয়ে রাখায় বিল নিতে রাজি হয়নি। হয়তো আবারও বিব্রত হলেন তিনি। কোনো কথা না বলে, কোনো বিদায় সম্ভাষণ না জানিয়ে একটি খালি রিকশায় উঠে বসলেন তিনি। ঈদের দিনের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে রিকশা। আর রাস্তা ফাঁকা এবং মানুষশূন্য বলেই অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো রিকশাটা। আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি। কেন জানি তাকিয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে আমার। তার সন্তানদের চিনি না। কোনোদিন দেখিনি। দেখার প্রশ্নও উঠে না। তবুও চোখের সামনে ভাসতে থাকে একের পর এক দৃশ্য। মধ্যবয়স্ক এই লোকটি রিকশা থেকে নেমেছেন শহরের কোনো এক প্রান্তে। সেটি বাংলামোটর, গোড়ান, বাড্ডা, মিরপুর, হাজারিবাগ, লালবাগ, শান্তিনগর যে কোনো জায়গা হতে পারে। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে হেঁটে চলেছেন তিনি। হয়তো অল্প একটু দূর হাঁটা পথ শেষে তার বাসা। হয়তো সেটি খুব সরু গলি। হয়তো সেখানে রিকশা ঢোকে না। কিংবা হয়তো একেবারে ঘরের দরজার সামনেই নেমেছেন। তারপর একবার, মাত্র একবার মৃদু হাতে কড়া নাড়তেই খুলে গেছে বাসার দরজা। কারণ এই ভাড়া বাড়ির তিনটি সন্তান জানে তাদের জন্য কোরবানির মাংস আনতে গেছেন তাদের বাবা। তাই তারা অপেক্ষা করছে কখন ফিরবেন। হয়তো মৃদু হাতে কড়া নাড়ার শব্দেই সন্তানরা বুঝে গেছে এটি তাদের বাবার কড়া নাড়ার শব্দ।

হয়তো তার হাতের মাংসের পোটলাটি দেখে দৌড়ে এগিয়ে এসেছে তাদের সবচেয়ে ছোট সন্তান। হয়তো বাবার হাত থেকে ছোঁ মেরে ব্যাগটি কেঁড়ে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে ভোঁ দৌড় দিয়েছে সেই শিশুটি। হয়তো তখন রান্নাঘরে বসে তাদের মা মাংস রান্নার জন্য পেঁয়াজ কুটছিলেন। হয়তো মা পেঁয়াজ কুটছিলেন না। বরং জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলেন বাইরের দিকে। সেখানে আশপাশের বড় বড় বিল্ডিংয়ের ফাঁক গলে হয়তো এক চিলতে আকাশ দেখা যাচ্ছিল অথবা যাচ্ছিল না। হয়তো মাংসের পোটলা হাতে পেয়ে মা, মাংস কোটাবাছার পর রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হয়তো ছোট্ট শিশুটি বলছিল- মা আজকে চাল একটু বেশি করে দিবা। আজকে কিন্তু আমি অনেক ভাত খাবো! মা হয়তো তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছিলেন- আচ্ছা খেয়ো। যতো খুশি খেয়ো। ওদিকে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বাবা হয়তো ততোক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন সেই বিকেলে। কিংবা তিনি হয়তো বসে বসে টিভি দেখছিলেন। হয়তো ঘরময় গরম মশলার মৌ মৌ গন্ধে বিভোর তখন। গরম পোলাও থেকে ধোঁয়া উঠছে। সবাই মিলে খেতে বসেছে টেবিলে। হয়তো সেই বাড়িতে কোনো খাবার টেবিল নেই। হয়তো সবার চোখে মুখে লেগেছে কোরবানির ঈদের আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। এতো সব আনন্দের মাঝে শুধু বাবার মনটা খচখচ করছে খুব। তার সব অশ্রু বাষ্প হয়ে মিশে যাচ্ছে গরুর মাংসের সালুনের খুশবু আর পোলাওয়ের ধোঁয়ায়। নিজের অভাবকে কোরবানি দিতে না পারা গাঢ় অক্ষমতায় বাবার গলা দিয়ে হয়তো খাবার নামতে চাইছে না। তবু তিনি খুব আনন্দ নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করছেন।

 

হঠাৎ সিটি করপোরেশনের একটি ময়লাবাহী ঘড়ঘড় শব্দ তুলে এগিয়ে আসে রাস্তা ধরে। আর ময়লার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ ঝাপটা মারে নাকে। চোখের সামনে থেকে সরে যায় একটি সুখি পরিবারের মায়াবি পর্দা। খেয়াল করে দেখি নিভে গেছে হাতের সিগারেট। আরো এক প্যাকেট সিগারেট কিনে হাঁটতে থাকি বাসার দিকে।
খুব ক্লান্ত লাগে।

সূএ: রাইজিংবিডি.কম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com